ব্লগ সম্পর্কিয় কথা

স্বরচিত কবিতা এবং অনুগল্প পাঠান , সপ্তাহের সেরা নির্বাচিত লেখাগুলো ব্লগে পোস্ট করা হবে।

Thursday 27 September 2018

রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি

রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি
~পল্লবী সমাদ্দার

সাত্যকি অফিসের ডেস্ক টা পরিষ্কার করতে করতে এক ফাঁকে দেখে নিল মোবাইলে কত পারসেন্ট চার্জ আছে! ওদিকে পাওয়ার ব্যাঙ্কটা চার্জ হচ্ছে. পাওয়ার ব্যাঙ্কটা লাল থেকে সবুজ হলেই মোবাইল টা চার্জে বসাবে. মোবাইলে চার্জ ২০% এর নীচে নেমে গেলেই সাত্যকির অস্বস্তি হতে থাকে. এ এক অদ্ভুত ব্যামো. মোবাইল ছাড়া তার এক সেকেন্ড - ও চলে না. মেহুলী মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে রেগে মেগে বলে " মোবাইল টাই তো তোর গার্লফ্রেন্ড, আমার কি বিশেষ কোনো দরকার আছে?'. তাতে অবশ্য সাত্যকি খানিক লজ্জা বোধ করে, লাজুক হাসি হেসে মোবাইল সরিয়ে রাখে একপাশে. ৫ মিনিট যেতে না যেতেই যে কে সেই, লম্বা লম্বা আঙুল গুলো অভ্যেসবশেই কি-লক খুলে ফেলে.এই অ্যাপ সেই অ্যাপে ঘুরতে থাকে আঙুল .  ৫:৩০ টা বাজতেই সাত্যকি মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঝটপট উবার বুক করে. আজ তার বিশেষ তাড়া আছে. ফাইন আর্টস গ্যালারীতে আজ মেহুলীর কিছু ছবির এক্সহিবিসন আছে. আজ-ই শেষদিন , তাই সময়মত পৌছতে না পারলে মেহুলী হুলীগান হয়ে গান  টান-ও চালিয়ে দিতে পারে. এইসব ভাবতে ভাবতে সাত্যকির জন্য ক্যাব চলে আসে. এক্সিহিবিসন ছাড়াও আরো একটি কারণে আজ তার বিশেষ তাড়া. অনেকগুলো টাকা খরচ ক'রে সাত্যকি তার নতুন ফ্ল্যাটে আজ ডিজিটাল লক ইনস্টল করতে চলেছে, রাতে সেই সিস্টেম ইনস্টল করতে দুজন লোক আসার কথা. ডিজিটাল সিস্টেমের মজাটা হোলো সেটা মোবাইল থেকে অপারেট করা যাবে. মানে সেন্সর লাগানো ডিভাইস, যার ৫০০ মিটারের মধ্যে মোবাইল নিয়ে এলেই ডিভাইস সেন্স করতে পারে মোবাইল -এর রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি. তারপর প্রোগামিং করা নম্বরে আঙুল ছোঁয়ালেই হোলো. এতকিছু শুনে মেহুলী বলেছিল " একেই তো তুই মোবাইল অন্ত প্রাণ তার ওপর আরো একটা ডিপেন্ডেন্সি বাড়াচ্ছিস ".

ফাইন আর্টস গ্যালারীর গেট দিয়ে ঢুকতেই মেহুলীর দেখা মিলল. "তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, দেরী করছিস দেখে ভাবলাম আসবি না বোধহয়".

- সাত্যকি মিচকি হেসে উত্তর দিল " না এলে ধরণী দ্বিধা হতে বাকি থাকত বলতে চাইছিস?"

-মেহুলী কপট রাগ দেখিয়ে বলল " বাজে বকিস না ভেতরে চল, ভেতরে তোর সাথে আর বেশী কথা হবে না, আজ দুজন আর্ট কিউরেটর আসার কথা, তাদেরকে কনভিন্স করতে পারি কিনা দেখি".

সাত্যকি আর মেহুলী দুজনে একসাথে গ্যালারীতে ঢোকে. মেহুলী অন্য অনেকের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে. সাত্যকি একা একা ঘুড়ে ছবি গুলো দেখতে থাকে. কিছু নামী শিল্পীদের ছবির সাথে মেহুলীর গোটা দশেক ছবি প্রদর্শিত. সাত্যকি খুঁজে খুঁজে সেগুলোই বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে. ছবি টবির ব্যাপারে সাত্যকির জ্ঞান খুবই সীমিত. মর্ডাণ আর্ট-এর তো কিছুই সে বুঝতে পারে না. ইদানীং তো বই পড়ার অভ্যেস টাও গেছে. কিন্ডেলে কখোনো সখোনো পড়ে বটে. কিন্তু তাও খুব-ই কম. মেহুলীর ক্রিয়েটিভ সিগনেচার করা ছবি হঠাৎ দেখতে পেয়ে খুব আনন্দ হোলো সাত্যকির. মেহুলীর ছবি গুলো দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল ৪ টে ছবির থিম খানিকটা একরকম. একটি ছবিতে অনেকগুলো নিউরোন , ছন্নছাড়া, বিক্ষিপ্ত, নীল বা ধূসর রঙের. উজ্জ্বল রঙের তরন্গ দৈর্ঘ্যের মত দেখতে তুলির টান সারা ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে. তরন্গ গুলো বেরোচ্ছে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মত দেখতে একটা কিছু থেকে, ডিভাইস টা অনেক টা মোবাইল ফোনের মত দেখতে লাগছে. কোনো কোনো নিউরোন আবার ছিড়ে খুড়ে গেছে. আর একটি ছবিতে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে আষ্টেপৃষ্ঠে আকড়ে ধরেছে দুটো হাত , সেই হাত গুলো একটি ছোট্ট মোবাইল থেকে বেড়িয়ে বৃহদাকার হয়েছে. পরের ছবিতে পিনিয়াল গ্ল্যান্ড মানে ঠিক দুই ভ্রুর মাঝখানে একটি ছোট্ট ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মত দেখতে কি জানি কি! দূরে দরজায় তালা আটকানো. হঠাৎ মেহুলী এসে পিছনে দাঁড়ায়, "বাব্বা এখোনো আছিস ,চলে যাসনি যে!"

-"কিসব একেছিস হুলীগান? মাথা মুন্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না!"
-"যেখানে সেখানে আমায় হুলীগান ব'লে ডাকিস নাতো! কি ভাব্বে লোকে! " - বলেই আশে পাশে একটু দেখে নেয় মেহুলী.
সাত্যকি হাসতে হাসতে বলে "জলদি বোঝা এগুলোর মানে কি!"
মেহুলী সাত্যকির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে "আরে তুই নিজের সাথে মিল পাচ্ছিস না?"
সাত্যকি মাথা টাথা চুলকে " যাহ্ ত্তারা আমি আবার কোত্থেকে এলুম! কিসব যে বলিস তোরা শিল্পী মানুষ কিসুই বুঝি না, আমি হলাম গিয়ে সফ্্টওয়ারের লোক, এসব বোঝা কি আমার কম্ম!!"
-"ঠিক আছে পরে বোঝাবো তোকে, আমি বরং একটু ওইদিকটায় যাই, তুই কি এখুনি বেরোবি!"

সাত্যকি মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে ক্যাব বুক করে. এখনো হাতে ১ ঘন্টা মত সময় আছে. এখান থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই বাড়ি পৌছে যাবে আশা করা যায়. সাত্যকি ফোন করলে তারা বাড়িতে এসে সিস্টেম ইনস্টল করে যাবে -এইরকম কথা হয়েছিল.
মোবাইলে কি-লক খুলে ফোন নম্বরটা খুঁজতে থাকে সাত্যকি. কল লিস্ট টা কেমন মনে হচ্ছে  বদলে গেছে, যাদের সকাল থেকে কল করেছিল তাদের কারোর নম্বর খুঁজে পাচ্ছে না, সকালেই তো ফোন করেছিল লোকটাকে. ফোন রি-স্টার্ট করে. আবারো কল লিস্ট বদলে গেল, এবার অন্যান্য সব নম্বর. কি যে হোলো মোবাইল টার, দুমাস আগেই তো কেনা হোলো! সাত্যকি নম্বরটা মনে করার চেষ্টা করে. নাহ্ কিছুতেই মনে পড়ছে না. সেই যে ল্যান্ড লাইনের যুগে নম্বর মুখস্থ থাকত ,মোবাইল আসার পর সেসব পাট চুকে গেছে. আরো একবার সাত্যকি কল লিস্ট ঘাটে, আবারো বদল ঘটেছে সেটার. একি! কল লিস্ট জুড়ে সব পুরোনো ল্যান্ড লাইন নম্বর! এগুলো তো তার মোবাইলে কখনো সেভ করাই ছিল না. সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে. এক ঘন্টা পেরিয়ে যায় , সাত্যকি নম্বর খুঁজে পায় না. মনসংযোগ করে নম্বর মনে করার চেষ্টা চালায়, কিন্তু তাও পারে না. মোবাইল টা কেমন কেঁপে উঠল মনে হল. কিন্তু ভাইব্রেশন মোডে তো নেই. কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হোলো কে যেন হাসছে. হাসির আওয়াজ টা পেল সাত্যকি , কিন্তু কোথা থেকে আসছে কিছুই বুঝতে পারছে না. ওদিকে সময় পেড়িয়ে যায়, ডিজিটাল ডোর লক ইনস্টলেশন আর করা হয় না. ল্যাপটপ টাও আজ সে অফিসে রেখে এসেছে তাড়াহুড়োয়. কাল ভোরে অনসাইট থেকে এক ক্লায়েন্টের ইম্পর্ট্যান্ট কল রিসিভ করতে হবে . অ্যালার্ম না দিলে অত ভোরে সাত্যকি উঠতে পারে না. মোবাইলে অ্যালার্ম দিতে গিয়ে দেখে মোবাইল অন হচ্ছে না. মহা জ্বালা তো! মোবাইল টা কি আবারো একটু কেঁপে উঠল? আবার সেই বিচ্ছিরি হাসির শব্দ - "খ্যাঁক খ্যাঁক" , কোত্থেকে যে আসছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সাত্যকি.

ক্লান্ত বিষণ্ণ শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল সাত্যকি, মনে নেই. মাঝরাতে হঠাৎ হিস্ হিস্ শব্দে ঘুম ভাঙে তার. মোবাইল টা মাথার কাছে দপ্ দপ্ করছে, শব্দটা কি ওটা থেকেই আসছে! অন্ধকারেই মোবাইল টা হাতে নেয় সাত্যকি, কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোথাথেকে দুটো হাত এসে সাত্যকির মাথা চোখ মুখ কান চেপে ধরে. সাথে গা শিউরানো হিস্ হিস্ আওয়াজ, "খ্যাঁক খ্যাঁক "- বিদ্রুপাত্মক হাসি. ছটফট করতে থাকে সাত্যকি, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না. মেহুলীর আঁকা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের ছবি, উজ্জ্বল রঙের তরন্গ দৈর্ঘ্যের ছবি মনে পড়তে থাকে সাত্যকির. প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে সে, কিছুতেই পারছে না, শ্বাস আটকে আসছে যেন, পারছে না কিছুতেই ছাড়াতে, কিছুতেই পারছে না.

1 comment:

  1. ভীষণ ভালো লাগলো পড়ে, ভাষার ব্যবহার ও শব্দের বুনোট এক কোথায় অনবদ্য ! সাত্যকির মতো আমরাও যে আজ যন্ত্রের কারাগারে বন্দি হয়ে পড়েছি সেটা বলাই বাহুল্য, আপনার লেখনীর ছোঁয়ায় সেই যান্ত্রিক যন্ত্রনাটা যেন আরো প্রকট ভাবে অনুভব করতে পারলাম । আপনার আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম ।

    ReplyDelete

সুগঠনবিশিষ্ট পোষ্টগুলি